অজয় ভট্টাচার্য একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও চিত্রপরিচালক। হিমাংশু দত্ত ও শচীন দেব বর্মন সহ বহু সুরকারের সুরে ও বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তার লেখা বেশকিছুগান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। অধিকার, শাপমুক্তি, নিমাই সন্ন্যাস, মহাকবি কালিদাস প্রভৃতি চলচ্চিত্রের গল্প বা সংলাপ রচনা করেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন:
অজয় ভট্টাচার্যের জন্ম বৃটিশ ভারতের ত্রিপুরার শ্যামগ্রামে। তার পিতা রাজকুমার ভট্টাচার্য কুমিল্লায় ওকালতি করতেন। মাতা শশীমুখী দেবী। সেকারণে অজয়ের পড়াশোনা শুরু হয় কুমিল্লায় দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বর পাঠশালায়। পরে সেখানকার স্কুলে ছাত্র থাকাকালীন সংগীত, সাহিত্য, গান, নাটক ইত্যাদিতে পারদর্শিতা জন্মে। তার উপর পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় কুমিল্লা শহরে বেশ নামডাক হয়। পরে তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাশ করেন। চিত্র পরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠী ছিলেন।
চলচ্চিত্রে অবদান:
চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন রেকর্ড—উভয় ক্ষেত্রেই তার লেখা গান সাড়া জাগিয়েছিল। বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই তার গান অনেক প্রচলিত ছিল। তিনি দুই হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। তার প্রথম লেখা গান – হাসনুহানা আজ নিরালায় ফুটলি কেন আপন মনে। তার গানগুলি অনেক সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে একদিন যবে গেয়েছিল পাখি, আজো ওঠে চাঁদ, আমার দেশে যাইও সুজন, যদি মনে পড়ে সেদিনের কথা, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গান লেখা ছাড়াও অজয় ভট্টাচার্য চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপ রচনা করেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সফল ছিলেন। তার পরিচালিত চলচ্চিত্র দুটি হচ্ছে অশোক ও ছদ্মবেশী।
কবিতা চর্চা:
অজয় ভট্টাচার্য কবি ছিলেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ রাতের রূপকথা, ঈগল ও অন্যান্য কবিতা, সৈনিক ও অন্যান্য কবিতা, ইত্যাদি।
সুজন দাশগুপ্ত তার সম্পর্কে লিখেছেন:
কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের জন্ম জুলাই, ১৯০৬, ত্রিপুরার শ্যামগ্রাম বলে একটি গ্রামে। কিন্তু বড় হয়েছেন বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে বাবা যেখানে ওকালতি করতেন। পড়াশোনার শুরু কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায়। ভালো ছাত্র ছিলেন। শুধু পড়াশুনো নয় সাহিত্য, গান, নাটক, ইত্যাদি নানায় বিষয়ে ওঁর প্রচুর উৎসাহ ছিল। বাংলায় এম এ পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে কুমিল্লায় ফিরে গিয়ে কিছুদিনের জন্যে কুমার বোর্ডিং-এ ত্রিপুরার রাজবাড়ির কুমারদের গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ নেন। সে চাকরি ছেড়ে ত্রিপুরার কুমার শচীন দেববর্মণের আমন্ত্রণে কলকাতায় চলে আসেন।
শিক্ষকতার চাকরি পেলেন কলকাতার তীর্থপতি ইনস্টিট্যুশনে। কিন্তু আয় মূলতঃ হত গান আর সিনেমার জন্যে গল্প ও সংলাপ লিখে। অজয় ভট্টাচার্য কবিতাও লিখতেন, কিন্তু ওঁর মুখ্য পরিচয় গীতিকার হিসেবে। ওঁর প্রথম গান ‘হাসনুহানা আজ নিরালায়’; গানটিতে সুর দেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। হিমাংশু দত্তও ছিলেন কুমিল্লা লোক। অজয় ভট্টাচার্যের লেখা আরও অনেক গানে উনি সুর দিয়েছিলেন। পরে ওঁর গানে সুর সুর দিতে দেখি শচীন দেববর্মণ, পঙ্কজ মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, অনুপম ঘটক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সে যুগের বিশিষ্ট সুরকারদের। গেয়েছেন শচীন, সায়গল, পঙ্কজ, কানন দেবী, হেমন্ত প্রমুখ শিল্পীরা।
অজয় ভট্টাচার্যের রচিত গানের সংখ্যা প্রায় দু-হাজারের কাছাকাছি ১। অন্যত্র দেখি যে ওঁর রচিত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গানের সংখ্যা আনুমানিক দেড় হাজারের মত ২। বাংলায় সবচেয়ে বেশী গান লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম – সংখ্যায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার। তার পরেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা – দুহাজারের কাছাকাছি। ‘অজয়-গীতিসংগ্রহ’ বইয়ের ভূমিকায় নারায়ণ চৌধুরী লিখেছেন, ‘সংখ্যা সব সময়ে সৃষ্টির উৎকর্ষতা নিরূপণের নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি নয়, তবে…এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় সৃষ্টির অনায়াস উৎসারশক্তি, কল্পনার সাবলীলতা ও সম্বৃদ্ধি।’ এর পর যখন দেখি অজয় ভট্টাচার্য স্বল্পায়ু জীবনের মাত্র পনেরো বছর ব্যয় করতে পেরেছিলেন ওঁর গানগুলি রচনার জন্যে – তখন মনে হয় সংখ্যাটি দেড় হাজারের বেশ কিছু কম হলেও বিস্মিত হবার পক্ষে যথেষ্ট।
অজয় ভট্টাচার্যের গানের জগৎ ছিল বহুবিস্তৃত — কাব্যগীতি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, বাউল, রাগপ্রধান, কীর্তন, সাধনসঙ্গীত, ভজন ইত্যাদি। কাব্যগীতিতে বিষয়-বৈচিত্র্য ছিল প্রচুর। রোমান্টিক গান তো ছিলই – তাতে রূপকথার ছোঁয়াও ছিল (‘রূপকথারি রাজা এসে তুলে নিল পারুল ফুল’, ‘রাজার কুমার পক্ষীরাজে’ ইত্যাদি)। শেষের দিকের রচনা আবার অনেকটা বাস্তবমুখি। রোমান্স-বর্জিত আঙ্গিকে গণ জাগরণের সুরও সেখানে ধ্বনিত হয়। এগুলির মধ্যে অনেক গান, বিশেষত ছায়াছবির গান এককালে অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিলো। ছবির গান ‘এই পেয়েছি অনল জ্বালা’, ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু’, ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’, ‘বাংলার বধূ’ গানগুলি লোকের মুখে মুখে ফিরত।
অজয় ভট্টাচার্যের জীবিত কালে ওঁর গানের তিনটি সংকলন প্রকাশিত হয় – ‘আজি আমারি কথা’, ‘মিলন-বিরহ-গীতি’ ও ‘শুক-সারী’। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ‘আজও ওঠে চাঁদ’। অজয় ভট্টাচার্যের অনেক গানের সুর দিয়েছিলেন শচীন দেববর্মণ। অজয় ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পরে স্বরলিপি সহ সেই গানগুলির একটা সংকলন তিনি ‘সুরের লিখন’ নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। বইটির নিবেদনে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার পরম স্নেহাস্পদ কবি অজয়কুমারের বহু গীতি-রচনায় আমি সানন্দে সুর যোজনা করেছি এবং এ কথাও আজকের দিনে গৌরবের সঙ্গেই প্রকাশ করছি যে কবির কথা ও আমার সুর সমাবিষ্ট হয়ে বিদগ্ধজনের সমাদর লাভ করেছে।
এর বহু বছর বাদে ১৯৯১ সালে ওঁর স্ত্রী রেণুকা ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘অজয় ভট্টাচার্যের গান’। এই গীতি সংকলনগুলি এখন আর বাজারে পাওয়া যায় কিনা জানি না। তবে সৌভাগ্যক্রমে সেগুলি হারিয়ে যায় নি – কবিপত্নী রেণুকা ভট্টাচার্যের সৌজন্যে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর ডিজিটাল সাউথ এশিয়া লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এই ডিজিট্যাল লাইব্রেরিতে অজয় ভট্টাচার্যের স্বহস্তে লেখা বেশ কয়েকটি পান্ডুলিপিও পাওয়া যাবে। পাঠকদের সুবিধার জন্যে এই রচনার নীচে বই ও একটি পান্ডুলিপির লিঙ্ক দেওয়া হল।
অজয় ভট্টাচার্য ছিলেন আধুনিক গানের প্রথম যুগের (মধ্য তিরিশ দশকে যার শুরু) অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। কারো কারো মতে প্রথম দিকে অজয়কুমার (রেকর্ডে ও প্রচারপত্রে অনেক সময়ে ঐ নামেই ওঁর পরিচিতি) ছিলেন নজরুল প্রভাবিত (রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তো সবার ওপরেই একটু আধটু ছিল)। কতটা প্রভাবিত?
অজয় ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিচারণ করেন চিত্র পরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায় ৩ – কথাপ্রসঙ্গে একদিন নাকি পশুপতিবাবু অজয় ভট্টাচার্যকে বলেছিলেন, ‘নজরুল একটা চমৎকার গান লিখেছে – কাল রেকর্ডে শুনলুম।‘
‘কী গান’, অজয় জিজ্ঞেস করলেন।
উত্তরে পশুপতিবাবু প্রথম লাইনটি গেয়ে শোনালেন,
‘হাসনুহানা আজ নিরালায় ফুটলি কেন আপন মনে?
ফুলদরদী তোর সেন বঁধু আসবে না আর ফুল-কাননে।’
শুনে অজয় ভট্টাচার্যের মুচকি হাসি। ‘গানখানা নজরুলের লেখা নয়।‘
‘ বলো কি? তাহলে এমন লেখা কে লিখল?”
‘আমি হে, আমি।‘
পরের দিকে অবশ্য অজয় ভট্টাচার্যের গানে নজরুলের প্রভাব চোখে পড়ে না। ওঁর শত শত গানের মধ্যে অনেকগুলিই কালজয়ী – ‘আধুনিক বাঙলা গানে’র জগতে চিরস্থায়ী আসন নিয়েছে। গানগুলি রয়ে গেছে, কিন্তু তাদের গীতিকার কে – অনেকেই বলতে পারবেন না। গীতিকার হিসেবে অজয় ভট্টাচার্য এখন প্রায় বিস্মৃত।
আরও পড়ুন: