আইয়ুব বাচ্চু | বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক

আইয়ুব বাচ্চু একজন বাংলাদেশী সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক ছিলেন। তিনি রক ব্যান্ড এল আর বি এর গায়ক ও গীটারবাদক হিসেবে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক বলা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।

আইয়ুব বাচ্চু | বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক

প্রাথমিক জীবন

আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নুরজাহান বেগম। তাদের পরিবার ছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তার মতে তাদের পরিবারে সবাই “অতি ধার্মিক ছিলেন এবং সঙ্গীত নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা কেউ গ্রহণ করেননি।” তারা তিন ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবীলি রোড এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন, যেখানে বাচ্চুর বেশিরভাগ কৈশর জীবন অতিবহিত হয়। ১৯৭৩ সালে তার বাবা তাকে তার ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। তার কৈশর জীবনের শুরুর দিকে সে বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করে, যেমন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রক ব্যান্ড লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্য জিমি হেনড্রিক্স এক্সপেরিয়েন্স ইত্যাদি।

তন্মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গীটার বাজানো তাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল। তাকে গীটার শেখাতো জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ মানুষ যে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে থাকতো। ১৯৭৬ এর দিকে সে তার এক বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইলেকট্রিক গীটার বাজাতো, যা ছিল একটি টিস্কো গীটার। পরে সে যখন গীটারটির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান, তার বন্ধু তাকে গীটারটি দিয়ে দেয়।

১৯৭৫ সালে তাকে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ১৯৭৯ সালে সে ওই স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল “গোল্ডেন বয়েজ”। পরে নাম বদলে করা হয় “আগলি বয়েজ”। সেই ব্যান্ডের গায়ক ছিল কুমার বিশ্বজিৎ এবং বাচ্চু ছিল গিটারিস্ট। সেই সময়ে তারা মূলত পটিয়ায় বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান গাইতো এবং শহরের বিভিন্ন ক্লাবে গান করতো। ১৯৮০ সালে বাচ্চু ও বিশ্বজিৎ যখন সোলসে যোগদান করে তখন ব্যান্ডটি ভেঙে যায় ।

আইয়ুব বাচ্চু | বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক

সঙ্গীতজীবন

১৯৭৭ সালে তার নিজের ব্যান্ডে কাজ করার পাশাপাশি সে ফিলিংস নামের একটি রক ব্যান্ডে যোগ দেন গিটার বাদক হিসেবে, যেখানে তিনি কাজ করেছিলেন জেমস এর সঙ্গে। জেমস বলেছিল, সে বাচ্চুকে একটি চায়ের দোকানে গিটার বাজাতে দেখেছিল এবং বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখেই সে তাকে ফিলিংসে যোগ করতে বলেন। বাচ্চু তার কথায় রাজি হয়ে যান এবং পরবর্তী তিন বছর, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওই ব্যান্ডে কাজ করেন।

১৯৮০ সালে সোলসের গিটার বাদক সাজেদ উল আলম উচ্চশিক্ষার জন্যে আমেরিকায় চলে যায়। একরাতে যখন ফিলিংস চট্টগ্রামের একটি ক্লাবে অনুষ্ঠান করছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিল সোলস ব্যান্ডের নকীব খান। বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং সোলসের গায়ক তপন চৌধুরী কে বাচ্চুর ব্যপারে বলেন। পরদিন রাতে তারা ফিলিংস এর অনুষ্ঠান দেখতে আসে এবং বাচ্চুকে সোলসে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বলেন।

বাচ্চু একই বছরের মাঝামাঝি সময়ে “আগলি বয়েজ” এর গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথে যোগ দেন। পরবর্তী দশ বছর সে সোলস এর মূল গিটার বাদক, গীতিকার এবং গায়ক (অনিয়মিত) হিসেবে কাজ করে। সে সোলসের সাথে চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল: সুপার সোলস (১৯৮২) যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম গানের অ্যালবাম, কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এই অ্যালবামটিতেই বাচ্চুর সোলসের হয়ে গাওয়া প্রথম গান “হারানো বিকেলের গল্প” প্রকাশ পায়।

সোলসের সাথে তার শেষ অ্যালবামটি ছিল ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, যা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে বাচ্চু ব্যান্ডটি ছেড়ে নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করেন, যা পরবর্তী সময়ে লাভ রানস ব্লাইন্ড বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে বাচ্চু সোলস থেকে বের হয়ে আসার পর ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারিতে ফেরদৌস চন্দনার সাথে বিয়ে করেন, যার সাথে তার ১৯৮৬ সাল থেকে সম্পর্ক ছিল। তিনি ‘”ইয়েলো রিভার ব্যান্ড”‘ নামের একটি ব্যান্ড গঠন করেন ৫ এপ্রিল ১৯৯১ সালে, এস আই টুটুল (কীবোর্ডস), সাইদুল হাসান স্বপন (বেজ গিটার) এবং হাবিব আনোয়ার জয় (ড্রামস)।

১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তারা ভারতে অনুষ্ঠান করতে গেলে তাদের ভুলে “লিটল রিভার ব্যান্ড” নামে পরিচিত করানে হয়। নামটি বাচ্চু পছন্দ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তার ব্যান্ড নামকরণ করে। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে, এলআরবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রথম কনসার্টটি করে। কনসার্টটি বামবা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যা স্বৈরাচারী নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর পতনের উদ্‌যাপন করেছিল।

১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে, তারা বাংলাদেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম: এলআরবি ১ এবং এলআরবি ২ প্রকাশ করেছিল। ব্যান্ডটির তৃতীয় স্টুডিও অ্যালবাম সুখ, জুনে মুক্তি পায় এবং এটি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রক অ্যালবামগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়।

এতে “চলো বদলে যাই” গানটি ছিল যা বাচ্চুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসাবে বিবেচিত। তারা ১৯৯০ এর দশকে আরও কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ করে এবং শীঘ্রই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রক ব্যান্ডের মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালে, তারা ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠান করেছিল, যা বাংলাদেশের বাইরে তাদের প্রথম কনসার্ট ছিল। এলআরবি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন অনুষ্ঠান করা একমাত্র বাংলাদেশী ব্যান্ড।

আইয়ুব বাচ্চু | বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক

পুরস্কার

বাচ্চু এল আর বি’র সাথে এবং একজন একক শিল্পী হিসেবে প্রচুর অ্যালবাম বিক্রয় করেছেন। বাচ্চু বাংলাদেশে একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদরক এবং অন্যতম প্রভাবশালী গীটারবাদক। এল আর বি’র সাথে সে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে। ২০১৭ সালে সে টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জিতেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন

বাচ্চু তার বান্ধবী ফেরদৌস চন্দনা’কে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারিতে। তাদের দু’টি সন্তান আছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব।

মৃত্যু

ছয় বছর ধরে ফুসফুসে পানি জমার অসুস্থতায় ভোগার পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকায় তার নিজ বাসভবনে মারা যান। মৃত্যুর দুইদিন আগে তিনি রংপুরে তার শেষ কনসার্ট করেন।তাকে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলি’তে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে, তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

আইয়ুব বাচ্চু | বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক

স্বীকৃতি

আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রূপালী গিটার আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরোনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয় রূপালী গিটার। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment