আব্দুল লতিফ | বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী

আব্দুল লতিফ একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশী গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো এর প্রথম সুরকার। পরবর্তীকালে তিনি নিজেও ভাষা আন্দোলনের উপর অসংখ্য গান রচনা করেছেন, তন্মধ্যে ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়, আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা ইত্যাদি সবিশেষ জনপ্রিয়।

প্রারম্ভিক জীবন

আব্দুল লতিফ বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। এ আকর্ষণ তাঁর গ্রামে তাঁকে গায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। গান গাওয়ার অপরাধে তাঁর ফুফু তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফুফুর কাছে গানগুলি ছিল ইসলাম বিরোধী। কিশোর আব্দুল লতিফ এ ঘটনার আকস্মিকতায় বিচলিত না হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফুফুকে একটি গান শোনাতে চান এবং তিনি সে প্রস্তাবে সম্মত হন। আব্দুল লতিফ আলাহ-রসুলের প্রশংসায় ভরা আববাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের একটি ইসলামি গান গেয়ে শুনান। গান শুনে ফুফু মুগ্ধ হন এবং তাঁকে গান গাওয়ার অনুমতি দেন। এভাবেই পারিবারিক স্বীকৃতি নিয়ে আবদুল লতিফের শিল্পিজীবনের শুরু।

 

আব্দুল লতিফ

 

সংগীত জীবন

উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি উচ্চ শিক্ষাতর্থে কলকাতায় যান। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে তিনি ১৬ বছর বয়স থেকে গান গাইতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকায় আসেন এবং পরের মাসে রেডিও পাকিস্তানের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন মঞ্চ অনুষ্ঠানে গান গাইতেন এবং ভাষা আন্দোলনে অণুপ্রেরণা যোগাতেন। ১৯৫২ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটিতে তিনি সুরারোপ করেন। পরবর্তীকালে গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদ এর সুরটিই টিকে আছে। তিনি তার জীবনে অসংখ্য গানে সুরারোপ করেছেন এবং কন্ঠ দিয়েছেন।

আব্দুল লতিফ এর গানগুলিতে পূর্ব-বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান-‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এ গানটিতে তিনি বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আবহ ও সুরকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গানটি পূর্ব বাংলার ঐতিহ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রতীকী গানের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।

আব্দুল লতিফ সঙ্গীতের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। বাল্যকাল থেকে গ্রামবাংলার জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, সঙ্গীতকলার সঙ্গে পরিচিত হলে তাঁর নিজের মধ্যে একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করে। উদার ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত আবদুল লতিফের সঙ্গীতে পরিস্ফুট হয় অসাম্প্রদায়িক লৌকিক গণচেতনা।

পুরস্কার ও সম্মননা

এদেশের সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০২ সালে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে।

মৃত্যু

২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

Leave a Comment