অনুপম ঘটক ছিলেন বাংলা সঙ্গীত জগতে এক কিংবদন্তি ভারতীয় বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রেও সুরারোপে করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র অগ্নিপরীক্ষায় অসামান্যভাবে ‘ডিমিনিশড কর্ড’ ব্যবহার করে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন এবং নিজস্বতা প্রমাণ করেন।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
১৯১১ সালের ১১ এপ্রিল ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল মহকুমার পাথরাইল গ্রামে জন্ম অনুপম ঘটকের। বাবা অতুলচন্দ্র ঘটক ছিলেন গানের মানুষ। ভালো গাইতেন। মা সুকুমারী দেবীরও উৎসাহ ছিল এ ব্যাপারে। অনুপম ছোট থেকেই সুরের আবহাওয়া পেয়েছিলেন। ঠাকুর্দা মাধবচন্দ্র ঘটক ছিলেন নামকরা চিকিৎসক।
অতুলচন্দ্রও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। ফলে, গানের পাশাপাশি শিক্ষার ধারাও ছিল পরিবারে। বাবার কাজের সূত্রে টাঙ্গাইল থেকে এলাহাবাদে গিয়ে, সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে পরিবার-সহ কলকাতায় চলে এলেন অনুপম ঘটক। অতুলচন্দ্র বিভিন্ন গানের আসরে গান শুনতে ও অনেকসময় গাইতেও যেতেন। সঙ্গে থাকতেন ছোট্ট অনুপম। খুব তাড়াতাড়ি কীভাবে যেন অপূর্ব বাঁশি বাজাতে শিখে গেলেন। সঙ্গে ছিল খেলাধুলার নেশা।
ছেলে এইসব নিয়ে মেতে উঠছে দেখে অতুলচন্দ্র আবার ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন টাঙ্গাইলে। সেখানেও কিন্তু সুরচর্চা অব্যাহত রইল। কাকা ধীরেন ঘটক খুব ভালো কীর্তন গাইতেন। বিভিন্ন আসরে গাইতে যেতেন। সঙ্গী হতেন অনুপম। এছাড়া, গ্রামের মাঝি-মাল্লা, চাষি, চারণকবিদের গানের সঙ্গেও নিত্য পরিচয় হতে লাগল।
অন্তরে গেঁথে গেল পল্লী বাংলার সুর। এর কিছুদিন পর, আবার এলেন কলকাতায়। আইএ পড়তে ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। কলেজেই দারুণ সুনাম হয়ে গেল গায়ক আর খেলোয়াড় হিসেবে। কলেজের পরীক্ষা দিয়েই বাবার ইচ্ছেতে রেলের চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করলেন। কিন্তু চাকরি নিলেন না। অন্তরে যাঁর সংগীতের প্লাবন চলছে, তাঁর কি এসব পোষায়?
সংগীত জীবন
বিএ পড়ার সময় বালিগঞ্জের একটি সোনার দোকানে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অনুপমের গাওয়া গান শুনলেন এমন একজন, যাঁকে বহুমুখী প্রতিভাধর বললেও বোধহয় কম বলা হয়। তিনি হলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, কাহিনিকার, অভিনেতা, চিত্র পরিচালক হীরেন বসু। জহুরীর চোখে তিনি ঠিক চিনে নিলেন আসল রত্নটিকে। কাছে টানলেন অনুপমকে।
তাঁরই উদ্যোগে ১৯৩০ সালে রেডিয়োতে প্রথমবার গাইলেন অনুপম ঘটক। ১৯৩২ সালে হীরেন বসুরই তত্ত্বাবধানে ‘হিন্দুস্থান’ রেকর্ড থেকে বেরোল অনুপম ঘটকের গাওয়া গানের রেকর্ড― ‘আজি সখি ঝর ঝর…’ এবং ‘জানি তোমার সাথে দেখা হবে সাগর কিনারায়…’। জনপ্রিয়তা পেয়েছিল গানদুটি। তার ফলে, একই কোম্পানি থেকে অনুপমের গাওয়া বিভিন্ন আঙ্গিকের বেশ কয়েকটা গানের আরও রেকর্ড বেরোল পর পর।
এবার তিনি এলেন ছায়াছবির দুনিয়ায়। এখানেও সেই হীরেন বসু। তাঁর পরিচালনা ও সংগীত-নির্মাণে তৈরি ‘মহুয়া’ (১৯৩৪) ছবিতে শুধু সহকারীর কাজ করলেন না, অভিনয় করে গানও গাইলেন অনুপম ঘটক। ১৯৩৫ সালে ‘বিদ্রোহী’ ছবিতে চারণকবির ভূমিকায় অভিনয় করে হিমাংশু দত্তের সুরে গাইলেন, ‘জাগো জাগো হে সুপ্তবীর…’।
ছবির আর একজন সুরকার ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। ছবিতে অন্য এক চারণকবির চরিত্রে অভিনয়-সহ গান গেয়েছিলেন শচীন দেববর্মণ। এ বাদে, ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরপারে’, ‘গৃহদাহ’, ‘কালপরিণয়’ ও ‘পল্লীবধূ’ (ছোট ছবি)-তেও গান গেয়েছিলেন অনুপম ঘটক।
এসবের মাঝখানেই শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিলেন মাস্তান গামা ও কে জি ঢেকনে-র মতো দুই অসামান্য সংগীতগুণীর কাছে। অন্তরে থাকা সংগীত সাম্রাজ্যের সঙ্গে এইসব গুণীজনের শিক্ষা মিশে জন্ম দিল অনুপম-ঘরানার।
‘পায়ের ধুলো’ (১৯৩৫) ছবিতে প্রথমবার এককভাবে সংগীত পরিচালনা করলেন অনুপম ঘটক, যাতে আটটি গান ছিল। লিখেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। অভিনয় করে দুটি গান গেয়েছিলেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়া গানে ছিলেন বীণাপাণি দেবী, কমলা দে। আরেকটি সাঁওতালি সুরে সমবেত গান ছিল― ‘গেয়ে যাই বাজিয়ে মাদল/নাচিয়ে বাদল/মাতোয়ালা গান…’।
এরপর, হীরেন বসু হিন্দি জগতে পাড়ি দিলে, তাঁরই আগ্রহে অনুপম ঘটকও ১৯৩৭ সালে গেলেন মুম্বই। সেখানে তাঁর সুরারোপে মুক্তি পেল কয়েকটি ছবি। প্রসঙ্গত, দু’বার তিনি কলকাতা ছেড়ে গিয়েছিলেন হিন্দি-উর্দু ছবির দুনিয়ায় কাজ করতে। প্রথমবার ১৯৩০ দশকে মুম্বই।
পরেরবার ১৯৪৪ সালে লাহোর। দুটি জায়গা মিলিয়ে অনুপমের সুরে মুক্তি পেয়েছিল, ‘ভোলেভালে’, ‘উসকি তমান্না’, ‘লেডিস ওনলি’, ‘চম্পা’, ‘আয়া বাহার’, ‘বদনামী’, ‘শালিমার’, ‘খুশনসীব’, ‘অ্যায়সা কিঁউ’, ‘ফয়সালা’, ‘বনজারে’ ইত্যাদি ছবি।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাঁধায় অনুপমকে ফিরে আসতে হয় বাংলায়। লাহোরে থাকার সময়, সেখানকার রেডিয়ো স্টেশনে অনুপম ঘটকের সহকারী হয়ে কিছুদিন কাজ করেছিলেন পরবর্তীকালে মুম্বইয়ের হিন্দি জগতের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক নৌশাদ।
অনেক পরে, ১৯৮০-র দশকে দূরদর্শনে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এক জায়গায় নৌশাদ সাহেব অনুপম ঘটকের সম্পর্কে বলেছিলেন― “I was an assistant of a musical genius named Anupam Ghatak at Lahore Radio Satation…”। অনুপম ঘটকের সাংগীতিক প্রতিভার উচ্চতা বোঝার ক্ষেত্রে এটুকু মন্তব্যই কি যথেষ্ট নয়? এ থেকে, এও মালুম হয় বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার গানেও কতটা নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন এই অসামান্য সংগীতব্যক্তিত্ব।
১৯৪০ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল কৃষণ মুভিটোনের ছবি ‘শাপমুক্তি’। অনুপমের সুরে এ ছবির প্রত্যেকটি গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল― ‘বাংলার বধূ বুকে তার মধু…’, ‘বনে নয়, মনে রঙের আগুন…’, ‘যে পথে যাবে চলি…’, ‘তোমার গোপন কথা…’, ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু…’। গানগুলো গাইলেন শৈল দেবী, সুপ্রভা ঘোষ (পরে সরকার), প্রতিভা (আন্না) সেন ছাড়াও প্রথমবার নায়ক-গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া রবীন মজুমদার, যিনি প্রথম ছবি থেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন অভিনয় ও গানে।
এর পিছনে পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়ার পাশাপাশি অনুপম ঘটকের সুরনির্মাণের ভূমিকাকেও স্বীকার করতে হবে। গান লিখেছিলেন অজয় ভট্টাচার্য এবং অনুপমের সহকারী হয়ে এ ছবিতে ছিলেন পরবর্তীকালের আর এক যুগন্ধর সংগীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়।
এরপর, ‘কর্ণার্জুন’ (১৯৪১), ‘মায়ের প্রাণ’ (১৯৪১), ‘পাষাণদেবতা’ (১৯৪২) ছবিতে সংগীত পরিচালনার পরে অনুপম ঘটক বিস্ফোরণ ঘটালেন ১৯৫০ সালের ‘শ্রীতুলসীদাস’ ছবিতে। কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, গান রচনা হীরেন বসুর। ভজন-কীর্তনের বন্যা বয়ে গেল গোটা ছবি জুড়ে। ছোট-বড়ো মিলিয়ে ২৮টি গান ছিল ছবিতে। তুলসীদাসের লিপের প্রত্যেকটা গানে মাতিয়ে দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
তেওড়া তালে তৈরি ‘লিখিনু যে লিপিখানি…’ গানের এক অসাধারণ কম্পোজিশন করলেন অনুপম ঘটক। বিশেষ করে সঞ্চারীতে ‘তোমারে নয়নে ভরি রাখি…’ অংশের একটা জায়গায় আজানধ্বনির টুকরো ছোঁয়া মিশিয়ে যে স্ক্যানিং করেছেন, তা ভাবা যায় না! হেমন্ত-কণ্ঠের আরও গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আমি তনুচন্দন বাটি রামনাম পাষাণে/ নয়ন সলিল ঢালি তায়…’। যেমন বাণী, তেমন সুর ও গাওয়া।
এছাড়া, গেয়েছিলেন জগন্ময় মিত্র, সাবিত্রী ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ শিল্পী। প্রসঙ্গত, হেমন্তর গান ‘লিখিনু যে লিপিখানি প্রিয়তমারে…’-র পাশাপাশি সাবিত্রী ঘোষ গেয়েছিলেন চার লাইনের একটি পদ, ‘লিখিনু যে লিপিগুলি প্রিয় তোমারে…’। অপূর্ব বাণীবিন্যাস!
এরপর, অনুপম ঘটকের সুরে সমৃদ্ধ যেসব ছবি মুক্তি পায়, সেগুলো হল, ১৯৫২ সালে ‘সঞ্জীবনী’, ‘কার পাপে’, ১৯৫৪-তে ‘কল্যাণী’, ১৯৫৫ সালের ‘অনুপমা’, ‘দেবী মালিনী’, ‘পরেশ’, ‘দৃষ্টি’, ১৯৫৬ সালে ‘কীর্ত্তিগড়’, ‘একটি রাত’, ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’, ‘অসমাপ্ত’ (এ ছবিতে আরও চারজন সংগীত পরিচালনা করেন), ‘নাগরদোলা’।
১৯৫৬ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুপম ঘটকের অকালপ্রয়াণের পর, ১৯৫৭-তে তাঁর সুরারোপিত যেসব ছবি মুক্তি পায়, সেগুলি হল, ‘সুরের পরশে’, ‘পরের ছেলে’, ‘মাধবীর জন্য’ ও ‘একতারা’ (এ ছবির টাইটেল-সংয়ের সুরটি করে যেতে পারেননি অনুপমবাবু, ওটি করেছিলেন তাঁর সহকারী হিসেবে ঐ ছবিতে থাকা দুর্গা সেন)। এছাড়া, ১৯৫৪-র ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে।
সিনেমা ছাড়া বেসিক বাংলা গানেও অনুপম-প্রতিভার বিচ্ছুরণ কিছু কম নেই। প্রথমেই বলতে হয়, হীরেন বসুর কথায় পঞ্জাবী ‘হির’ গানের অনুসরণে তৈরি অনুপম ঘটকের দুটি অতুলনীয় কম্পোজিশনের কথা― ‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি…’ ও ‘শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায়…’।
লাহোরে গিয়ে বেশ কিছু হিন্দি ও উর্দু ছবিতেও কাজ করেছেন তিনি। বাংলা ছবি একতারা ছিল তাঁর শেষ সুরারোপিত ছবি।অনুপম ঘটক অকস্মাৎ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর মাত্র ৪৫ বৎসর বয়সে প্রয়াত হন।
আরও পড়ুনঃ