গায়ত্রী মন্ত্র বাংলা লিরিক্স | Gayatri Mantra Lyrics | বৈদিক হিন্দুধর্মের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হল গায়ত্রী মন্ত্র। বহুকাল ধরে এই বিশ্বাসের প্রচলন আছে যে ,বেদের অন্যান্য মন্ত্রের ন্যায় গায়ত্রী মন্ত্রও “অপৌরষেয়” অর্থাৎ, কোনো মানুষের দ্বারা তা রচিত হয়নি এবং এই মন্ত্রটি ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র কাছে প্রকাশিত। বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত শক্তিশালী এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদের (মণ্ডল ৩।৬২।১০) একটি সূক্ত।
গায়ত্রী মন্ত্র বাংলা লিরিক্স | Gayatri Mantra Lyrics | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি”
গায়ত্রী মন্ত্র রচিত হয়েছে গায়ত্রী ছন্দানুসারে । হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্র এবং এই মন্ত্রে উল্লিখিত দেবতাকে অভিন্ন জ্ঞান করা হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রটির দেবীর নামও গায়ত্রী। এই মন্ত্র দিয়ে শুধু পূজা অর্চনা করাই হয় না , এই মন্ত্রকে স্বয়ং হিন্দু ধর্মে পূজাও করা হয়ে থাকে।হিন্দু দেবতা সবিতাকে আবাহন করা হয়ে থাকে গায়ত্রী মন্ত্রের মাধ্যমে তাই গায়ত্রী মন্ত্রের অন্য নাম “সাবিত্রী মন্ত্র”। সাবিত্রীর ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী গায়ত্রী মন্ত্র সূর্যপূজা, যোগ, তন্ত্র বা শাক্তধর্মের সঙ্গে বিশেষরূপে সংযুক্ত হয়ে আছে।
দেবী গায়ত্রী , Devi Gayatri
দেবী গায়ত্রীর তিনটি রূপ; প্রভাতে তিনি ব্রাহ্মী; রক্তবর্ণা ও অক্ষমালা-কমণ্ডলুধারিনী। মধ্যাহ্নে তিনি বৈষ্ণবী; শঙ্খ, চক্র, গদা ধারণকারিনী রূপে বিরাজমান। সন্ধ্যায় শিবানী; বৃষারূঢ়া, শূল, পাশ ও নরকপাল ধারিনী এবং গলিত যৌবনা রূপে প্রকাশিত। কথিত আছে, যে যজ্ঞকালে একদা ব্রহ্মার স্ত্রী সাবিত্রী একাকিনী যজ্ঞস্থলে আসতে অস্বীকার করলে, ব্রহ্মা রেগে গিয়ে অন্য নারীকে বিবাহ করে যজ্ঞ সমাপ্তি ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেন। ব্রহ্মার ইচ্ছা অনুযায়ী পাত্রী খুঁজতে বের হলে এক গোয়ালিনীকে পাত্রী হিসেবে মনোনীত করেন দেবরাজ ইন্দ্র। বিষ্ণুর অনুরোধে সেই রমণীকে কে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেন ব্রহ্মা । এই কন্যাই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে গায়ত্রী।
গায়ত্রী মন্ত্র ও তার বঙ্গানুবাদ :
‘ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ’॥

গায়ত্রী মন্ত্রের বঙ্গানুবাদ এবং অর্থ , Bengali translation and meaning of gayatri mantra
বঙ্গানুবাদঃ- পরমাত্মা হলেন প্রাণের প্রতিভূ, দুঃখনাশক ও সুখের আধার। তিনি আমাদের বুদ্ধিকে শুভ গুণ, কর্ম ও স্বভাবের দিকে চালিত করে থাকেন। সেই জগৎ সৃষ্টিকারী এবং ঐশ্বর্যপ্রদানকারী পরমাত্মার বরণযোগ্য পাপ-নাশক তেজকে আমরা ধারণ করে থাকি।
ভাবার্থঃ পরমাত্মাই জগতের সৃষ্টিকর্তা এবং জীবনের কর্মফলদাতা। তিনি মানবজীবনের একমাত্র উপাস্য; তাঁহার স্বরূপ চিন্তার মধ্যে ই লুকিয়ে আছে প্রকৃত উপাসনা । তাঁর পূজা করলে আপন বুদ্ধিমত্তা সঠিক পথে পরিচালিত হয় শুভ গুণ, কর্ম ও স্বভাবের দিকে যার দ্বারা জীবের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়ে থাকে।গায়ত্রী বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র রূপে চিহ্নিত । পরমাত্মার ধ্যানের উদ্দেশ্যে এই শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রটির মর্ম্ম উপলব্ধি করে প্রচার করেছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র।
এই মন্ত্রের দেবতা বা বিষয় ,’সবিতা’ হলেন জগৎ-স্রষ্টা ব্রম্ম। বৈদিক সংস্থার মতে আচার্যগুরু এই মন্ত্রে ব্রম্মচারীকে দীক্ষা দান করে থাকেন। গায়ত্রীর ধ্যানে রয়েছে: ‘তিনি সূর্যমণ্ডলের মধ্যস্তরে অবস্থানকারিনী, বিষ্ণু বা শিবরূপা, হংসস্থিতা বা গরুড়াসনা বা বৃষবাহনা। তিনি একাধারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব’।
হিন্দু বিধান অনুসারে, সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় এই মন্ত্র ধ্যান করতে হয় এবং এই মন্ত্র ধ্যান , পাঠ বা জপ করে মুক্তিএবং ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে বলে এর নাম ‘গায়ত্রী’। বেদজ্ঞ আচার্যগুরুর কাছে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হলে তার পূণর্জন্ম হয় ও তিনি দ্বিজ নামে পরিচিত হন। সেই কারণে বলা হয়ে থাকে,’ দ্বিজ’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণগণের উপাস্য এই মন্ত্র । বৈদিক গায়ত্রী মন্ত্রের অনুকরণেই অন্যান্য দেবতার গায়ত্রী রচিত হয়েছে যেমন: গণেশ, কালী, গুহ্যকালী, নারায়ণ, রাধা প্রভৃতি । প্রতিদিনের উপাসনায় এই মন্ত্র জপ বা পাঠ করা আবশ্যক। ঋগ্বেদের ২য় মন্ডলের ৩৮ সূক্তের ৭ থেকে ১১ নং মন্ত্রে সূর্য বা সবিতাকে সকল শক্তির আধার বলে তাঁর স্তুতি করা হয়ে থাকে।

গায়ত্রী মন্ত্রের বিশেষ দশটি শব্দ এবং তার অর্থ, The special ten words present in gayatri mantra and its meaning
যেমন- তৎ, সবিতুঃ, বরেণ্যম্, ভর্গঃ, দেবস্য, ধীমহি, ধিয়ঃ, যঃ, নঃ, প্রচোদয়াৎ। গায়ত্রী মন্ত্রের আগে প্রণব মন্ত্র “ওঁ” এবং “ভূর্ভুবঃ স্বঃ”(ভূঃ, ভুয়ঃ, স্বঃ) সংযুক্ত করে তা উচ্চারণ করার নিয়ম।
“ওঁ” এই ওঙ্কার শব্দটি প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বরের সর্বোত্তর নাম। এতে অ, উ এবং ম্ এই তিন অক্ষর একত্রিত হয়ে এক “ওঁ” সমুদায় হয়েছে। এই একটি নাম থেকে পরমেশ্বরের অনেক নাম সূচিত হয়ে থাকে। “অ”কার থেকে বিরাট, অগ্নি ও বিশ্ব প্রভৃতি; “উ”কার থেকে হিরণ্যগর্ভ, বায়ু, তৈজস্ব প্রভৃতি; “ম” কার থেকে ঈশ্বর, আদিত্য এবং প্রাজ্ঞ প্রভৃতি নাম সূচিত করা হয়ে থাকে।
“ওঁ” আদি নাম হল সার্থক যিনি রক্ষা করেন। তাই পরমেশ্বরের নাম “ওঁ”। আকাশের মত বিশাল বলে “খম” এবং সবার থেকে বৃহৎ বলে “ব্রম্ম” ই হল ঈশ্বরের নাম।
(ওমিত্যে) “ওঁ” যাঁর নাম, যিনি কখনও বিনষ্ট হন না এবং তাঁরই উপাসনা করা উচিত, অন্যের নয়।
(ওমিত্যেত) বেদাদি শাস্ত্র সমূহে “ওঁ” পরমেশ্বরের প্রধান নাম বলে ব্যক্ত করা হয়েছে, অন্য সমস্ত নাম গৌণিক।
(সর্বে বেদা) সকল বেদ ও সকল ধর্মানুষ্ঠান রূপ তপশ্চর্য্যা যাকে মান্য করলে ও যার প্রাপ্তি কামনা করলে ব্রম্মচর্য্য আশ্রমকে অবলম্বন করা হয়, তিনিই সেই পরম “ওঁ”।

“ভূঃ” কথাটির অর্থ প্রাণস্বরুপ,যিনি সর্ব প্রাণীকে প্রাণ প্রদান করেন,
“ভুবঃ” শব্দটির অর্থ দুঃখনাশক যিনি দুঃখ বিনাশ করেন।
“স্বঃ” অর্থ সুখ ; যিনি সর্বত্র বিরাজমান বা যিনি আনন্দের প্রতিভূ ; তিনিই স্বঃ
“তৎ” শব্দটির অর্থ হল ,’সেই’।
“সবিতুঃ” অর্থ হল সমগ্র জগতের প্রতিষ্ঠাতা ।
“বরেণ্যম্” শব্দের অর্থ হল বরণ যোগ্য সর্বোত্তম যিনি ।
“ভর্গোঃ” অর্থাৎ পাপ নাশক তেজকে বোঝায়।
“দেবস্য” অর্থ সমগ্র ঐশ্বর্য দাতা যিনি পরমত্মা প্রদান করে থাকেন যিনি জ্ঞানের উদ্দীপক। সেই অর্থে তিনি দেব রূপে চিহ্নিত।
“ধীমহি” অর্থ ধারণ করা বা ধ্যান করার সমার্থক।
“ধিয়ঃ” অর্থ প্রজ্ঞা সমূহ।
“যঃ” বা যিনি
“নঃ” বা আমাদের
“প্রচোদয়াৎ” অর্থ প্রেরণা প্রদান করে থাকেন।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥
গায়ত্রী মন্ত্র জপের মাহাত্ম্য, Importance of Gayatri mantra
হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে এই মন্ত্র জপ করলে ১) উৎসাহ এবং ইতিবাচকতা বৃদ্ধি পায়, ২) মানুষের মন ধর্ম ও সেবার কাজে নিয়োজিত থাকে ৩) ভবিষ্যদ্বাণীর সূচনা হয় ৪) প্রার্থণা করার বল বৃদ্ধি পায়, ৫) স্বপ্ন সাধনা হয়ে থাকে, ৬) মানসিক ক্রোধ শান্ত হয় ৭) মনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তৈরি হয়।
মন্ত্র জপ করার সঠিক সময় :
গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার প্রথম সময়টি হল প্রভাতে।মন্ত্রটির সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে জপ শুরু করা উচিত । মন্ত্র জপ করার জন্য দ্বিতীয় নির্ঘণ্ট হল দুপুরে। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা হয় বিকেলবেলা তেও। তৃতীয় সময় হল সন্ধ্যাকাল। সূর্যাস্তের আগে মন্ত্র জপ করা শুরু করা দরকার এবং সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরে জপ করা উচিত। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে চাইলে তা নিঃশব্দে বা মানসিকভাবে করা উচিত। মন্ত্র উচ্চারণসহকারে করা উচিত নয়।

গায়ত্রী মন্ত্রের প্রসারতা, Expansion of gayatri mantra
• আদিকালে প্রকৃতি উপাসক আর্য সভ্যতা গায়ত্রী মন্ত্রকে প্রকৃতির এক পরমতম রূপের নিদর্শনের উদ্দেশেই নিবেদন করেছিল। পরম্পরাগত বিশ্বাস এর বশবর্তী হয়ে বলা হয় যে মহর্ষি ভৃগু এর রচয়িতা।
• পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ গায়ত্রী মন্ত্রের অনুবাদ করেন— আমরা সেই পরমাত্মার উপাসনা করছি, যিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন। তিনিও আমাদের আলোকপ্রাপ্তির পথের দিশারী হিসেবে সহায়তা করেন।
• সম্ভবত গুপ্তযুগে গায়ত্রী মন্ত্রকে কেবল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল আর এই মন্ত্র ‘দ্বিজ’-দের উচ্চারণের যোগ্য বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। তবে প্রাচীন আর্য সমাজে ব্রাহ্মণরাই একা দ্বিজ হিসেবে গণ্য ছিলেন না , দ্বিজত্ব অর্জন করা যেত কর্মের দ্বারা।
• গায়ত্রী ছন্দকে সর্বশ্রেষ্ঠ ছন্দ বলে বর্ণিত করেন আর্য ছান্দসিকরা ।অপরূপ ও শ্রুতিমধুর সেই ছন্দেই এই মন্ত্র, গীত হয়ে ওঠে। এই মন্ত্রটি দিনের বিভিন্ন সময় উচ্চারিত হতে পারে তবে ঊষালগ্নে এই মন্ত্র উচ্চারণের বিধান রয়েছে কারণ দিনের এই ভাগ ই শুদ্ধতার প্রতীক বলে স্বীকার করে পৃথিবীর সব ধর্মমত ।